করোনাভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
একথা ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত যে করোনাভাইরাস আক্রান্ত কিছু রোগী একবার সুস্থ হলেও কিছুদিন পরে আবার লক্ষণ প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে এমনকি এরকম ক্ষেত্রে কিছু মানুষ মারা গিয়েছে। সম্প্রতি একাত্তর টিভিতে এ-নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে অনেক ডাক্তারদেরকে বলতে শোনা যায়, যে করোনাভাইরাসে পুনরায় সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু আসলেই কী তাই? পুনরায় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মানেই কি পুনরায় ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়া? এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণালব্ধ প্রমানাদি কী বলে? একজন অনুজীববিজ্ঞানী হিসেবে এ-নিয়ে কিছু বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
প্রথমেই দেখে নেই, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে, কখন একজন রোগীকে সুস্থ বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশের করোনাভাইরাস ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন অনুযায়ী, ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুইটা RT-PCR পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলেই রোগীদের করোনামুক্ত ধরা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, ন্যাজোফ্যারিঞ্জিয়াল সেম্পলের ক্ষেত্রে (নাকের ভেতর থেকে সাধারণত যেটা নেয়া হয়) RT-PCR টেস্টের ক্লিনিক্যাল সেন্সিটিভিটি কিন্তু খুব বেশী না; যা দ্বিতীয় সপ্তাহের পরে ৫০%-এর কাছাকাছি নেমে আসে। তার মানে, সুস্থ হয়ে উঠার মুহুর্তে রোগীর শরীরে ভাইরাসের পরিমান খুব কম থাকবে, যা স্যাম্পল কালেকশনের সময় ধরা নাও পড়তে পারে। তাই, ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুইবার RT-PCR নেগেটিভ আসলেই রোগীর শরীরে কোন ভাইরাস নাই একথা নিশ্চিত করে বলা যাবেনা, বরং অল্প কিছু ভাইরাস রয়ে যেতেই পারে।
এবার আসবে রোগীর ইমিউনিটির প্রসংগ। আমরা দেখেছি সাধারণত ১৪ দিনের মাথায় রোগীদের রক্তে ভাইরাস নিউট্রালাইজিং IgG এন্টিবডি পাওয়া যায়। কিন্তু খুব ভাল করে খেয়াল করতে হবে, ঠিক ১৪ দিনের মাথায় সব রোগীদের রক্তে ভাল পরিমান IgG পাওয়া যায়না; বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক দেরী লাগে (কিছু ক্ষেত্রে এক মাসের বেশী লাগে)। তার মানে, ইমিউনিটি দুর্বল থাকলে রোগীর শরীর থেকে ভাইরাস পুরপুরি দূর হতে সময় বেশী লাগবে। তাহলে RT-PCR-এর ক্লিনিক্যাল সেন্সিটিভিটির সীমাবদ্ধতার সাথে রোগীর দুর্বল ইমিউনিটি বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, ভাইরাস ক্লিয়ার হতে লম্বা সময় লাগলেও টেস্টে কখনো কখনো নেগেটিভে দেখাতে পারে। কিন্তু তাহলে পরে আবার পজিটিভ রেজাল্ট কেন পাওয়া যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে RT-PCR টেস্টের এনালাইটিক্যাল সেন্সিটিভিটিতে। মনে রাখতে হবে, RT-PCR টেস্টের সময় রিয়েকশন মিক্সচারে মাত্র একটা RNA উপস্থিত থাকলেও ৩০ সাইকেল পরে সেটা থেকে এক বিলিয়নের বেশী কপি তৈরি হয়। তার মানে, এমনকি একটা RNA থাকলেও পজিটিভে রেজাল্ট দেয়। তাই, রোগীর শরীর থেকে প্রথমবার ক্লিয়ার না হওয়া একটা RNA-আসলেও সেখানে RT-PCR টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যায়। বিশ্ব-ব্যাপী পুনরায় ইনফ্যাকশন বলে প্রচার পাওয়া প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু তারপরও এটা যে পুনরায় নতুন করে ভাইরাসের আক্রমন না, সেটির কি কোন প্রমান আছে?
উত্তর হলো, আছে। কারন, এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে এন্টিজেন-টেস্ট (যা শুধু RNA-বদলে সক্রিয় ভাইরাসের প্রোটিনের উপস্থিতি নির্দেশ করে) নেগেটিভে পাওয়া যায়। তার মানে, এগুলো পরিপূর্ন ভাইরাস না। বরং আগেরবার ক্লিয়ার না হওয়া কিছু ভাইরাসের অবশিষ্টাংশ (বা রেসিডিওয়াল RNA পার্টিক্যাল)। আরেকটা প্রমান হলো, এই সমস্ত রোগীদের কাছ থেকে অন্য কেঊ সাধারণত আক্রান্ত হয়না, যেটা স্বাভাবিক ভাইরাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে হওয়ার কথা না।
তাই, এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে একথা মোটামুটি জোর দিয়ে বলা যায় যে, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া, পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার চাইতে বরং প্রথমবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হতে দেরী হওয়ার কারনে (মানুষের জীনগত কিছু বৈশিষ্ট এর পেছনে দায়ী) হতে পারে। আর তাই, শুধুমাত্র সন্দেহের উপর ভিত্তি করে এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ না করা এবং সোশাল মিডিয়াতে তথ্য প্রকাশ করার ব্যাপারে আরও দায়িত্বশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। কারন, এথেকে অনেকে প্রচার করেন যে ভাইরাস মিউটেশনের কারনে দ্বিতীয়বার সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে।
অনেকে এ-ও বলেন যে ভাইরাস আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে এখন তার প্যাথোফিজিওলজি পরিবর্তন করেছে। কিন্তু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, পুনরায় লক্ষণ পাওয়ার এই ধরনের রিপোর্ট সেই উহানে প্রথমবার করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত চলে আসছে। সুতরাং এটা নতুন কিছু নয়।
অনেকে আবার প্রচার করেন, দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশী থাকছে। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে সেরকম বড় কোন পার্থক্য ধরা পড়েনি। প্রথমবার লক্ষণ প্রকাশিত হলেও অনেক মানুষ মারা যায়, তাই দ্বিতীয়বার লক্ষণ সহ কেউ মারা গেলেই সেটা নিয়ে আলাদা করে বিচলিত হওয়ার কারন এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আবার রক্তে করোনাভাইরাসের এন্টিবডি বেশীদিন স্থায়ী না হওয়ার সাথে এই পুনরায় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ঘটনাকে নিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা, পুনরায় লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রথমবার সুস্থ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে, আর লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে এন্টিবডি পাওয়া গিয়েছে তিন মাসের অধিক সময় ধরে। বরং এন্টিবডি কমে যেতে পারে যাদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের কোন লক্ষণ ছিলোনা, তাদের (পুনরায় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া ব্যাক্তিরা না)।
সবশেষ কথা হলো, এ নিয়ে অনেক ধরনের গবেষনা চলমান আছে এবং সামনে নিশ্চই আরও অনেক কিছু জানা যাবে। তবে প্রমানাদি ছাড়া শুধু নিজেদের ধারনার উপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে কোন কথা বলে দেয়া কারো জন্যই ঠিক হবেনা মনে করি। ধন্যবাদ। (পত্রিকার লিংক কমেন্টে আছে। আমার ছবি দেখতে দেখতে লোকজন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে বিধায় আর লিংক শেয়ার করলামনা
লেখকঃ