রক্তে অতিরিক্ত চর্বি কিভাবে কমাবেন?
রক্তে অতিরিক্ত চর্বির পরিমাণ বলতে বুঝায় রক্তের কোলেষ্টরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে এবং উপকারী চর্বি যেমন- হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এর মাত্রা কমে যাওয়াকে বুঝায়।
কোলেস্টেরল, ট্রাই গ্লিসারয়েড ইত্যাদি চর্বির মাত্রা রক্তে বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, শরীরের বিভিন্ন রক্তনালীর অ্যাথেরোস্ক্লোরোসিসসহ বহু অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। অথচ একটু সতর্ক হলে রক্তে চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক পরিশ্রম কমে গেছে, খাদ্যাভ্যাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ‘ফাস্টফুড’ ও অন্যান্য উপাদেয় খাবার এখন বহু মানুষের পছন্দ। সহজলভ্যও। এর ক্ষতিকর প্রভাবে মানুষ স্থূল হয়ে পড়ছে। কম বা পরিশ্রম না করা, মুটিয়ে যাওয়া, উপাদেয় কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কারণে কিছু অসুখ বেশি হচ্ছে। যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি। এ ধরনের অসুখ হওয়ার অন্যতম কারণ রক্তে অতিরিক্ত চর্বি জমা। সাধারণত চর্বি জমা বলতে শরীর মুটিয়ে যাওয়া বা বিশেষ কোনো অংশে অতিরিক্ত চর্বি জমা বোঝানো হয়। কিন্তু চর্বির একটি অংশ রক্তে জমা থাকে। অনেকেই মনে করে রক্তে চর্বি থাকা মানেই ক্ষতি, তা কিন্তু নয়। স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়ার জন্যই রক্তে চর্বি থাকা জরুরি। কিন্তু এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীরকে বাঁচাতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাখা দরকার।
রক্তের চর্বি কি ধরনের হয়?
রক্তে অনেক ধরনের উপাদান থাকে। এর মধ্যে চর্বি বা স্নেহজাতীয় উপাদানগুলোই রক্তের চর্বি বা কোলেস্টেরল নামে পরিচিত। এগুলো রক্তে যায় আমাদের গৃহীত খাদ্য থেকেই। তবে সরাসরি নয়। মূলত যকৃৎ বা লিভারে খাদ্য সংশ্লেষণের সময় এগুলো উদপাদিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি হচ্ছে টোটাল কোলেস্টেরল, টিজি বা ট্রাইগ্লিসারাইড, লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এবং হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন। এগুলোর আদর্শ মাত্রা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া যাক। টোটাল কোলেস্টেরল ২০০ গ্রাম/ডে.লি এর সমান বা এর কম, ট্রাই গ্লিসারাইড ১৫০ গ্রাম/ডে.লি এর সমান বা এর কম, এলডিএল ১০০ থেকে ১২৯ গ্রাম/ডে.লি এর মধ্যে, এইচডিএল ৪০ গ্রাম/ডে.লি এর সমান বা বেশি। কোলেস্টেরল ও লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এলডিএল রক্তে অধিক থাকলে তা বেশি ক্ষতিকর, ট্রাইগ্লিসারাইডও কম থাকা ভালো। আর হাই-ডেনসিটি লাইসোপ্রোটিন বা এইচডিএল যত বেশি থাকবে তত বেশি শরীরের জন্য উপকারী।
রক্তে অতিরিক্ত চর্বি কী ক্ষতি করে?
রক্তে প্রবাহিত অতিরিক্ত চর্বি রক্ত প্রবাহের ধমনির গায়ে লেগে যায় এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এভাবে চর্বি জমে রক্তনালিকে সরু করে দেয়। ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় বা রক্ত প্রবাহিত হতে বাধা পায়। যে অঙ্গে সরবরাহকারী ধমনিতে এই ব্লক বা বাধার সৃষ্টি হয়, সংশ্লিষ্ট অঙ্গটি রক্ত কম পায়। ফলে অক্সিজেন ও খাদ্য কণিকার অভাবে অঙ্গটি ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়তে থাকে এবং মানুষ রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। যেমনঃ
- হৃদপিণ্ডের নিজস্ব রক্তনালিতে ব্লক হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়া বা ‘হার্ট অ্যাটাক’ হওয়া।
- মস্তিষ্কের রক্তনালিতে ব্লক হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়া বা ‘স্ট্রোক’ হওয়া, রক্তনালি ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তপাত বা ব্রেন হেমোরেজ হওয়া।
- হাত-পায়ে রক্তপ্রবাহ কমে গিয়ে ঝিন ঝিন করা, অসাড় হওয়া, পচন ধরা ইত্যাদি।
- লিভারে চর্বি জমে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়া। ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার হতে পারে।
- চামড়ায় চর্বি জমে জ্যানথেলেস্মা হওয়া, ইত্যাদি।
রক্তে অতিরিক্ত চর্বি জমে কেন?
মূলত জীবন যাপনের ধরনই রক্তে চর্বি বাড়ার মূল কারণ।
- কম হাঁটা, বেশি বসে থাকা, অলস জীবন যাপন করা।
- অধিক চিনি, চর্বি ও তেলযুক্ত খাবার গ্রহণ
- খেলাধুলা ও ব্যায়াম না করা।
- পরিশ্রমের কাজ না করা বা পরিশ্রম করার মানসিকতা না থাকা।
- শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, ইত্যাদি।
তবে অনেক সময় দেখা যায় একই ধরনের জীবন যাপন সত্ত্বেও কারো সমস্যা কম, কারো বেশি হতে পারে। এর মূল কারণ জেনেটিক বা জিনগত।
আবার বেশকিছু রোগে আক্রান্ত হলেও রক্তে চর্বি বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের রোগের মধ্যে আছে—
- ডায়াবেটিস।
- নেফ্রোটিক সিনড্রোম ধরনের কিডনি রোগ।
- হরমোনজনিত রোগ, যমন- কুশিং সিনড্রোম।
- থাইরয়েড হরমোন ঘাটতিজনিত রোগ (হাইপোথাইরয়ডিজম)।
- অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস ধরনের লিভার রোগ ইত্যাদি।
অনেকে অন্য রোগের জন্য কিছু ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করে থাকেন। এ ধরনের ওষুধেও রক্তে অতিরিক্ত চর্বি জমার প্রবণতা হতে পারে। যেমন—
- থায়াজাইড ডাইইউরেটিকস ধরনের উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন।
- গ্লুকোকর্টিকয়েড জাতীয় স্টেরয়েড ওষুধ।
- মুখে সেবনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধ।
- টিপিক্যাল অ্যান্টিসাইকোটিক বা মনোরোগের কিছু ওষুধ ইত্যাদি।
রক্তে চর্বির আধিক্য বোঝার উপায় কি?
সাধারণভাবে রক্তে চর্বি বাড়লে বাইরে থেকে বোঝাার উপায় নেই। কারণ দৃশ্যত শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এর মাত্রা নির্ণয় করাই রক্তে চর্বির আধিক্য বোঝার মূল উপায়। তবে দীর্ঘ সময় চর্বির মাত্রা বেশি থাকলে চোখের চার পাশে, হাতের কুণুই অংশে, পায়ের গোড়ালির অংশ হলুদ রঙের কিছু ছোট ছোট বস্তু দেখা যায়, যেগুলোকে বলে জ্যানথেলেস্মা। রক্তের চর্বির মাত্রাপরীক্ষার জন্য রাতের খাবারের পর ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা সব ধরনের পানাহার বিরত থেকে সকালে খালি পেটে ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করে পূর্বে উল্লিখিত ৪ প্রকার চর্বির মাত্রা জানা যায়। শুধু খালি পেটে থাকলেই হবে না, আগের রাতের খাবারটা যেন অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনে আমরা রেন্ডম বা ভরা পেটে যেকোন সময় পরীক্ষাটি করতে পারি। এতে উল্লেখিত ৪ প্রকার চর্বির মধ্যে ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রার কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
যাদের নিয়মিত রক্তের চর্বি পরীক্ষা করা উচিত—
- ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে সবার বছরে একবার।
- পরিবারে রক্তে অতিরিক্ত চর্বি বা চর্বিজনিত রোগের ইতিহাস থাকলে এবং বয়স ২০ বছরের বেশি হলে বছরে একবার।
- যেসব রোগে চর্বি বাড়ে, যেমন ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়ডিজম ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হলে বছরে একবার।
- চর্বিজনিত রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, যেমন—হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদিতে যত দ্রুত সম্ভব।
- স্থূলকায় হলে বছরে অন্তত দুবার।
অতিরিক্ত চর্বি জমা ঠেকাতে কি করতে হবে?
সচেতনতা, জীবন যাপন পদ্ধতির স্বাস্থ্যসম্মত পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবনই এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার মূল উপায়।
- ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো চিহ্নিতকরণ, প্রথমে নিজের জীবন যাপনে সহজ কিছু স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনা। ধীরে ধীরে পরিবারের সবার জন্যই স্বাস্থ্যকর অভ্যাস তৈরি করার চেষ্টা করা।
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন। প্রতিদিন ২০০-৩০০ মি. গ্রাম কোলেস্টেরল শরীরের জন্য যথেষ্ট। তাই এর চেয়ে বেশি কোলেস্টেরল আছে—এ ধরনের খাবার কম খাওয়া।
- পরিহার করতে পারেন বা কম খেতে পারেন ডিমের কুসুম, গরু বা খাসির মাংস, কলিজা, মগজ, পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ ও দুধজাত খাবার (মাখন, মার্জারিন, পনির, মেয়োনিজ ইত্যাদি) কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড।
- খাদ্য তালিকায় বেছে নিন মাছ, মুরগি (চামড়া ছাড়া), ননিহীন দুধ, জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল, লাল চাল, লাল আটা ইত্যাদি।
- বেশি খাবেন সব ধরনের সবুজ শাক-সবজি, ফল, কাঠবাদাম বা আমন্ড, সবুজ চা বা গ্রিন টি, সামুদ্রিক মাছ।
- খাবার থেকে দৃশ্যমান চর্বি বাদ দিন। তেলযুক্ত ঝোল অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
- শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। এ জন্য সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন নিয়মিত ৩০-৪০ মিনিট শরীর চর্চা করুন বা মধ্যম গতিতে হাঁটুন।
- দৈনন্দিন কাজে হাঁটাকে প্রাধান্য দিন—অফিসে মাঝেমধ্যে ৫ মিনিট হেঁটে নিন, লিফটে না উঠে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। ঘরে বসে বসে টিভি না দেখে, একটু ছাদে গিয়ে বেড়িয়ে আসুন।
- সন্তানদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করুন, নিজেও অংশ নিন।
- ধূমপান বর্জন করুন। ধূমপান রক্তে চর্বি ও তত্সংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি করে।
- রক্তের চর্বির মাত্রা বেশি পাওয়া গেলে অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকই চর্বি কমানোর ঔষধ নির্ধারণ করে দিবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ ফলোআপ করবেন।
ডাঃ সাইফুল ইসলাম টিপু চৌধুরী
ডা. সাইফুল ইসলাম টিপু চৌধুরী এমবিবিএস পাশ করেন বগুড়া মেডিকেল কলেজ থেকে। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে হৃদরোগ বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তা ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশাল কার্ডিওলজিতে বিভিন্ন উচ্চতর ট্রেনিং এর পাশাপাশি হৃদরোগ নির্নয়ে অস্ট্রিয়া থেকে ডিপ্লোমা ইন ইকোকার্ডিওগ্রাফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০২২ সালে আমেরিকান কলেজ অব্ ফিজিশিয়ান থেকে "ফিজিশিয়ান অব্ দ্যা মানথ্" অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন এবং ফেলোশিপ ডিগ্রি "এফএসিপি" অর্জন করেন। তিনি ২০২৩ সালে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব্ কার্ডিওলজি থেকে ফেলোশিপ ডিগ্রি "এফইএসসি" অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি হৃদরোগ, বাতজ্বর, উচ্চ রক্তচাপ ও মেডিসিনের রোগী যত্ন সহকারে চিকিৎসার পাশাপাশি একজন গবেষক হিসেবেও বেশ পরিচিত। তাঁর গবেষণাসমৃদ্ধ প্রায় ৪০টি প্রবন্ধ দেশী ও বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়। তিনি Clinical Cardiology Update, London, Journal of Clinical Cardiology, USA; Journal of International Case Report এবং Hypertension and Co-morbidities জার্নাল এর এডিটরিয়াল বোর্ড মেম্বার হিসেবে কাজ করছেন।
অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভালো লেগেছে, এককথায় অসাধারণ।