হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হই | বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২১
Use Heart To Connect Heart, হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হই। এটা হল এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান। এ স্লোগানের অন্তর্নিহিত বিষয় হল হার্টের সুস্থতা বিষয়ে আন্তরিক হওয়া। এই স্লোগানকে সাথে নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্বব্যাপি হৃদরোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য এ দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন ও ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অরগাবিনাইজেশন যৌথভাবে বিশ্ব হার্ট দিবস পালনে সম্মত হয়। এই হার্ট দিবস সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারনা দেন ১৯৯৭-৯৯ সেশনে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্বে থাকা অ্যান্থনি বেইস্ ডি লুনা।
প্রথম হার্ট দিবসটি পালন করা হয় ২০০০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবারটি বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে পালন করা হতো। পরবর্তিতে ২০১১ সাল থেকে ২৯শে সেপ্টেম্বর দিনটিকে বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
হৃদপিন্ড হচ্ছে মানুষের শরীরের একমাত্র অঙ্গ, যেটা আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রাখে, কেননা মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যু হলেও আমরা তাকে জীবিত বলতে পারি যতক্ষণ পর্যন্ত হৃদপিন্ডের কার্য ক্ষমতা সচল থাকবে। বর্তমানে, মানুষে মৃত্যুর যত কারণ আছে, হৃদপিন্ড ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে মৃত্যু হলো সবচেয়ে বেশি। এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০০০ সালের শুরু থেকে প্রতিবছর ১৭ মিলিয়ন লোক মারা যায় এই হৃদপিন্ড ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে। দেখা যায়, হৃদপিন্ডে রক্তনালির ও মস্তিষ্কের ষ্ট্রোক জনিত কারণে মৃত্যুর হার ক্যান্সার, এইচআইভি-এইডস্ এবং ম্যালেরিয়া থেকেও বেশি। বর্তমানে ৩১% মৃত্যুর কারণ ধরা হয় এই হৃদরোগ ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে এবং অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০% কারণও এ হৃদরোগকে দায়ী করা হয়।
হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষন হল এনজাইনা, শ্বাস কষ্ট হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন হওয়া বা বুক ধড়ফড় করা ইত্যাদি। এনজাইনা হচ্ছে, রোগীর সাধারণত বুকে ব্যথা, বুকে চাপ অনুভব করা, বুক ভার ভার হওয়া, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি। কারো করোনারি আর্টারী বা হার্টের রক্তনালির ৭০ শতাংশ ব্লক হয়ে গেলে তখনই এনজাইনা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এনজাইনা থেকে র্হ্টা অ্যাটাক হয়। আবার করোনারি ধমনি যখন ১০০ শতাংশ ব্লক হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ফলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষের এটি হয়ে থাকে। আমাদের এদেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের এটি হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে আমাদের দেশের লোকের ১০ বছর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এখন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, এমনকি ২৫-৩০ বছর বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হলো- স্বাস্থ্য সম্মত খাবার না খাওয়া, ধুমপান ও তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করা ও অ্যালকোহল পান করা।
এ ছাড়া এ অঞ্চলে দূর্বল হার্ট বা কার্ডিওমায়োপ্যাথী একটি পরিচিত হৃদরোগ যেখানে হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বাতজ্বর জনিত হৃদরোগ বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা। সাধারণত ছোট বেলায় বাতজ্বর থেকে পরবর্তীতে বাতজ্বর জনিত হৃদরোগ হয়ে থাকে। বাতজ্বর জনিত রোগে সাধারণত হার্টের ভাল্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর মধ্যে কিছু রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব। আর কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। যদি সময়মতো চিকিৎসা করা না হয় তাহলে পরবর্তীতে শৈল্য চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হতে পারে।
হৃদরোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে যদি কারো পরিবারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকে এবং কিছু ক্ষেত্রে শিশুর জন্মগত হৃদরোগ থাকে, সেক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের কিছুই করার থাকে না।জন্মগত কারণে শিশুদের হৃদপিন্ডের দুটি প্রধান ত্রুটি, যেমন- ভেন্ট্রিকালার সেপ্টাল ডিফেক্ট (VSD), এট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (ASD) সাধারণত আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। সহজ কথায়, হৃদপিন্ডের মধ্যে চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয়। ডান ও বাম অলিন্দ একটি পর্দা দ্বারা পৃথক থাকে এবং ডান ও বাম নিলয়ও আরও একটি পর্দা দ্বারা পৃথক। যদি দুই অলিন্দের মাঝখানের পর্দার কোন ছিদ্র থাকে তাকে এএসডি(ASD) বলে আর যদি দুটি নিলয়ের মাঝখানের পর্দায় কোন ছিদ্র থাকে, তখন তাকে ভিএসডি (VSD) বলে। এ সমস্যায় অক্সিজেনযুক্ত রক্ত কার্বণ ডাই অক্সাইডযুক্ত রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। সাধারণত শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় হার্টের ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে আমরা হার্টের জন্মগত রোগগুলো নির্ণয় করি।
হৃদরোগের ঝুকি এড়াতে আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন- স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহনের পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। হৃদরোগ প্রতিরোধে কায়িক পরিশ্রম করা, হাঁটাহাঁটি করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা, ধূমপান না করা এবং সুষম ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবস পালনের উদ্দেশ্যে আমাদের হার্টের যত্ম নেওয়ার জন্য কয়েকটা বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। সেগুলো হল আপনার হার্টকে জানুন, হার্টকে শক্তিশালী করুন ও হার্টকে ভালবাসুন। যখন আপনার হার্টের অসুখ থাকবে, তখন সবকিছুতে নিজেকে ক্লান্ত মনে হবে। আপনি ক্রমাগত বৃদ্ধ হতে থাকবেন। আপনি হয়ে যাবেন অনুভূতিহীন। তাই নিকোলাই লেনিনের ভাষায় বলতে হয় “The most important thing in illness is never to lose heart” অর্থাৎ শত অসুস্থতার মধ্যেও যাতে আমরা হৃদয় হারা না হই।
এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মাঝে হৃদরোগ সম্পর্কিত জ্ঞান দেয়া হয়, যাতে তারা সময়মত হার্ট পরীক্ষা, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ধুমপান বর্জন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমে নিজেদের নিয়োজিত রাখে, স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাওয়া এবং অ্যালকোহল পান থেকে নিজেকে বিরত রাখার মাধ্যমে নিজেদের হার্টকে সুস্থ ও সচল রাখতে পারে। তাই সাধারণ জনগণকে তাদের জীবন অভ্যাস পরিবর্তনে উৎসাহ প্রদান করা ও হৃদরোগ সম্পর্কিত জ্ঞান প্রদান করাই বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল উদ্দেশ্য।
২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হলো অসংক্রামক ব্যাধি জনিত মৃত্যুর হার হ্রাস করা এবং অল্প বয়সে হৃদরোগ জনিত কারণে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। তাই বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে হৃদরোগ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা এবং আমার, আপনার হার্টের সুস্থতা ধরে রাখা। কেননা, হার্টের প্রতিটা স্পন্দনই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
ডাঃ সাইফুল ইসলাম টিপু চৌধুরী
ডা. সাইফুল ইসলাম টিপু চৌধুরী এমবিবিএস পাশ করেন বগুড়া মেডিকেল কলেজ থেকে। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে হৃদরোগ বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তা ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশাল কার্ডিওলজিতে বিভিন্ন উচ্চতর ট্রেনিং এর পাশাপাশি হৃদরোগ নির্নয়ে অস্ট্রিয়া থেকে ডিপ্লোমা ইন ইকোকার্ডিওগ্রাফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আমেরিকান কলেজ অব্ ফিজিশিয়ান থেকে ফেলোশিপ ডিগ্রি "এফএসিপি" অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি হৃদরোগ, বাতজ্বর, উচ্চ রক্তচাপ ও মেডিসিনের রোগী যত্ন সহকারে চিকিৎসার পাশাপাশি একজন গবেষক হিসেবেও বেশ পরিচিত। তাঁর গবেষণাসমৃদ্ধ প্রায় ৪০টি প্রবন্ধ দেশী ও বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়। তিনি Clinical Cardiology Update, London এবং Journal of Clinical Cardiology, USA এর এডিটরিয়াল বোর্ড মেম্বার হিসেবে কাজ করছেন।