COPD বা হাঁফানী নিয়ে কিছু কথা

গতকাল বুধবার বিশ্বব্যাপী পালিত হলো হাঁফানী সংক্রান্ত রোগের অভিভাবক সংস্থা GOLD ও বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বিশ্ব হাঁফানী বা COPD দিবস।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো-
“Living Well with COPD – Everybody, Everywhere”.
সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে এ দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পালিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায় না।
অসংক্রামক অন্যান্য রোগের মতোই হাঁফানী নির্মুলের কোন চিকিৎসা নেই। তাই হাঁফানীর কারণ কি ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন জরুরী। তা জানা থাকলে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং অনেকাংশেই প্রায় স্বাভাবিক ও দীর্ঘ জীবন যাপন করা সম্ভবপর হয়।
এই রোগের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের প্রায় ২১০ মিলিয়ন লোক হাঁফানীতে আক্রান্ত এবং ঘাতক হিসেবে এর স্থান চতুর্থ, ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সালে এটার স্থান হবে ৩য়। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় তিন মিলিয়ন লোক মারা যায় এ রোগে। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে কোন সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় বয়স্ক লোকদের মধ্যে ৭-১৭% হাঁফানীতে আক্রান্ত।
হাঁফানী কেন হয়?
হাঁফানী রোগ সাধারণত ৪০ বছরের পরে হয়ে থাকে, যার প্রধানতম কারণ হচ্ছে ধুমপান। অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বংশগত, জৈব জ্বালানী বা গবাদি পশুর গোবরের জ্বালানী ব্যবহার ও তার সংষ্পর্শে থাকা, পরিবেশ ও শিল্প দুষণ ইত্যাদি।
গবেষনায় দেখা গেছে যাদের হাঁফানী আছে তাদের শতকরা ৯০ ভাগই ধুমপায়ী অন্যদিকে ধুমপায়ীদের ১০-১৫% এর হাফানী হয়ে থাকে। বংশগত হাঁফানী রোগীদের ধুমপানের ইতিহাস থাকলে তাদের হাঁফানী হয় অতি তাড়াতাড়ি এবং দ্রুতই তাদের জন্য খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করে।
বাংলাদেশে বয়স্কদের প্রায় ৫৪% লোক ধুমপায়ী। সংগত কারণে মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের হাঁফানী রোগ বেশী হয়।
বিন্দু থেকে সিন্দুর মতো এ রোগ ধীরে ধীরে বাড়ে। প্রথম দিকে টের পাওয়া যায় না। ফুসফুসের প্রদাহ হয়ে হঠাৎ একদিন বিস্ফোরণের মতো জানান দেয় হাফানী এসে গেছে। তাদের যাত্রা চলতেই থাকে, পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। হাঁফানী রোগীদের অর্ধেকই জানে না তাদের নিজেদের মধ্যে হাঁফানী আছে।
হাঁফানীর বিভিন্ন ধাপ?
এ রোগের চারটা পর্যায় বা স্টেজ আছে। প্রথম দুটো স্টেজ নমনীয় ও প্রাথমিক পর্যায়ের। তখন থেকেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিলে,ধুমপান ত্যাগ করলে এ রোগের বর্ধনটা শ্লথ করা যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে নিরাময় ও করা যায়।
প্রাথমিক স্টেজে সামান্য কাশি দিয়েই এ রোগের যাত্রা শুরু হয়। সচেতনতা ও রোগ সম্পর্কিত ধারণার অভাবে বেশীর ভাগ রোগীরা এটাকে ঠান্ডাজনিত সাধারণ কফ কাশি হিসেবে অগ্রাহ্য করেন। কারো কারো বক্তব্য এটা ধুমপানজনিত স্বাভাবিক কাশি। চিন্তার কিছু নেই। কিন্ত ফ্যাসফ্যাসে গলায় কুক কুক চলতেই থাকে, সাথে বের হয় কিছু কিছু কফও।
শারীরিকভাবে তেমন কোন শ্বাস কস্ট বা অস্বাভাবিকতা অনুভব না করায় এ স্টেজ বা ধাপে অনেকে চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ চিকিৎসা নেন তবে অনিয়মিত ও অবহেলায়।
রোগ যখন তৃতীয় স্টেজ বা ধাপ পার হয়ে যায় তখন রোগীরা একটুতেই হাফিয়ে উঠেন। সিঁড়ি ভাঙ্গতে হাপর উঠে, জোর কদমে পদচলায় হাফিয়ে পড়েন, এমন কি পরিধেয় কাপড় চোপড় ধৌত করা, নিজের চলাফেরার জন্য স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে গেলেও শ্বাসকস্ট অনুভব করেন। ঠিক এ সময়ে রোগীরা নিজেদেরকে চিকিৎসকের কাছে সোপর্দ করেন এবং পরিপূর্ণ চিকিৎসা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
কিন্তু ততক্ষণে জীবন প্রদীপের সলতে অনেকটুকু ক্ষয়ে পড়ে, ফুসফুসের সংকোচন প্রসারণ ক্ষমতা প্রায় লুপ্ত হয়ে যায়, স্থিতিস্থাপকতা সম্পন্ন দু ফুসফুস পরিত্যক্ত বাজারের থলের মতো ঢিলেঢালা হয়ে ক্রমাগত বাতাসের জন্য ফুঁপাতে থাকে। জোড়া তালি দিয়ে কত আর চালানো যায়। এক সময় জীবনের শেষ শ্বাস টানটা দিয়ে ভার বহনের ইতি ঘটান।
এটাই হচ্ছে হাঁফানী রোগ ও রোগীর করুণ ইতিহাস।
চিকিৎসার সংকট ও ভুল ধারণাঃ
১) এ রোগের চিকিৎসাটা শুরুই করতে হয় ইনহেলার বা একোহেলার বা ডিভাইস ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এবং চিকিৎসার ইতি ঘটে বিছানা বন্দী অবস্থায় নাকে অক্সিজেনের নল দিয়ে।
ভুল ধারনার কারণে অধিকাংশ রোগী ইনহেলার নিতে চান না। কোন এক দুর্বোধ্য কারণে ইনহেলার গ্রহণ করাটাকে মনে করা হয় কাপনের শাদা কাপড় কিংবা চিতায় মাদার কাঠের দহন।
সবারই একই বক্তব্য- ‘আগে মুখের ঔষধ দিয়ে চেষ্টা করেন। ইনহেলার নিলে এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে’। তাদেরকে ইনহেলার গ্রহণ করাটা একান্তেভাবেই অভ্যাসে পরিণত করতে হবে এ কথাটা কেউই বুঝতে চান না। তাছাড়া মুখে গ্রহনকারী ঔষধ গুলোর অনেক কস্টকর ও ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে যা ইনহেলারে তেমন নেই। তাছাড়া স্থানিকভাবে ক্রিয়া শুরু করায় এটার কার্যকারীতাও দ্রুত এবং কার্যকর।
২) বেশীর ভাগ রোগী ডিভাইস ব্যবহার ও পাফ নেয়ার কৌশল জানেন না কিংবা তাদেরকে শিখিয়ে দেয়া হয় না, ফলে চিকিৎসাটা হয় অপর্যাপ্ত বা কম ফলদায়ক। চিকিৎসকের উচিত ডিভাইসের সাহায্যে পাফ নেয়ার সঠিক পদ্ধতিটা রোগীকে শেখানোর ব্যবস্থা করা।
৩) অনেকেই চিকিৎসা নেন কিন্তু রোগের ইন্ধনদাতা কারণ গুলো ত্যাগ করেন না। যেমনঃ ধুমপান। ইনহেলার ও চলছে ধুমপান ও চলছে।
সাপে নেউলের যুদ্ধ।
আগুন পানি সমানে সমান।
এ যে আরেক তামাশা।
যেন নিজে খেলা করা হাতে নিয়ে নিজ–প্রাণ।
৪) হাঁফানী রোগীর জীবন সংকট তৈরী হয় ফুসফুসে জীবানুঘটিত হঠাৎ কিছু প্রদাহের আক্রমণের কারণে। প্রদাহ তৈরীকারী এ সব জীবাণু বিরোধী কিছু টীকা বাজারে পাওয়া যায় যা চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক গ্রহণ করলে প্রদাহজনিত প্রবলতার হার কমে আসবে।
৫) হাঁফানীর কোন নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা নেই। তাই আমৃত্যু এ চিকিৎসা নিতে হবে। এ বিষয়টা অনেকেই রোগীকে বলেন না কিংবা অনেক রোগী তা মানতে চান না। ফলে পরিপূর্ণ সুস্থতার উদগ্র বাসনায় রোগীরা দেশে বিদেশে ঘুরতে থাকে চিকিৎসকের দ্বারে দ্বারে। অনেকে বিকল্প চিকিৎসা নিতে গিয়ে সময়ের আগেই ঝরে পড়েন কেউ কেউ আর্থিক ও মানসিক ভাবে এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন যে নিজে এবং পরিবার দুটাকেই বিপর্যস্ত করে ফেলেন।
৬) এর চিকিৎসা খরচ অনেক ব্যয়বহুল। আমৃত্যু এই চিকিৎসা চালানোর মতো সামর্থ্য আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মানুষেরই নেই। বিশেষ করেন ইনহেলার এবং শেষ পর্যায়ের অক্সিজেনের যোগান দেয়া বেশীর ভাগ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই এ সব জীবন রক্ষাকারী ঔষধের দাম কমানো বা সুলভে সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। এ। ব্যাপারে সরকারী কোন উদ্যোগ নেই।
সমাজের দানশীল বিত্তবানরা এগিয়ে আসতে পারেন। বিপন্ন দুয়েক রোগীর দায়ভার গ্রহণ করে তাকে ইনহেলার, নেবুলাইজার, অক্সিজেন এসবের যোগান দিতে পারেন। শ্বাসের জন্য যুদ্ধরত একজন বিপন্ন সৈনিককে উদ্বেগাকুল অস্থির সময়ে শীতলতার পরশ দিতে পারেন।
আসুন, হাঁফানী প্রতিরোধে সচেতন হই। ধূমপান নিবারণ করি। জৈব জ্বালানী পরিত্যাগ করি। দূষণমুক্ত জীবিকা নির্বাহে সচেষ্ট হই। তাহলেই কমিয়ে আনা যাবে শ্বাসকস্ট জনিত এই রোগ।

ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম
ডাঃ মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। ইন্টারনাল মেডিসিন-এ এমডি ডিগ্রীধারী এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সরকারী চাকুরীর পাশাপাশি বর্তমানে পার্কভিউ হসপিটালে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে রোগী দেখছেন।