পারিবারিক স্বাস্থ্য বাজেট | ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম
বেশ ক’বছর আগে কোন একটা কেজি স্কুলে তাদের বাৎসারিক স্বাস্থ্য চেকআপ প্রোগামে ছাত্র ছাত্রীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেশ দেয়ার জন্য আহুত হই। আগ্রহ নিয়ে গেলাম।
এসব স্কুল গুলো সাধারণত কানা গলির কোন একটা ভাড়া বিল্ডিংকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। কবুতের খোপের মতো ক্লাশ ঘর। গা লাগালাগি টাইপ সরু গলি। খুবই গরীব হাওলতের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা।
স্কুলের গিঞ্জি অবস্থা দেখে আমারই শ্বাসকষ্ট হবার অবস্থা। অনেক ছাত্র ছাত্রীকে গাদাগাদি করে বসানো হয়েছে। শিক্ষকদের বসার জায়গার অবস্থা আরো খারাপ। তাদের ওয়াশরুমটা দেখে মনে হলো এটা কদাচিৎ ওয়াশ হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ব্যবস্থটা কি রকম সেটা আর খোঁজ নেবার সুযোগ পেলাম না।
এ সব স্কুলে আবার হেড মাস্টার থাকেন না, থাকেন প্রিন্সিপাল বা ভাইস প্রিন্সিপাল। তারা সাধারণত সরকারী বা বেসরকারী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত কেউ একজন হয়ে থাকেন। তাদের দায়িত্বটা অনেকটাই পোশাকি ধরণের। নীতি-নির্ধারণী কাজ সারেন মূলত মালিক পক্ষের কেউ।
প্রিন্সিপাল সাহেবের ছোট্টরুমে বসে আছি। তেলাপোকা রঙের রেকসিন মোড়ানো টেবিল।চারপাশে নানান উচ্চতার কয়েক ডিজাইনের পুরোনো কেদারা। চিন্তা করছি ছাত্র ছাত্রীদের হাইজিন শেখানোর আগে স্কুলের পরিচালকদের সে বিষয়ে জ্ঞান দেয়া প্রয়োজন। পরে চিন্তা করলাম হোস্ট অপমান বোধ করতে পারেন। তাই সে পথে গেলাম না। কথা ঘুরিয়ে নতুন সাবজেক্ট ওপেন করলাম।
সাবজেক্টের নাম ”স্বাস্থ্য বাজেট”।
এটা সেটা বলার পর প্রিন্সিপাল মহোদয়কে জিজ্ঞাসা করলাম উনার পরিবারের কোন বাৎসরিক বা মাসিক স্বাস্থ্য বাজেট আছে কিনা।
তিনি আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, সেটা কি রকম?
সংক্ষেপে বললাম, এই যেমন ধরেন, বাচ্চার পড়ালেখা, উচ্চশিক্ষা, পারিতোষিক, মেয়ে বা ছেলের বিয়ের প্রস্তুতি ইত্যাদি খরচ মেটানোর জন্য আগে থেকেই যে রকম সঞ্চয় রাখা হয় সে রকমই একটা বাজেট।
পরিবারের কোন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তার জন্য যে বাড়তি খরচ তার চাপ সামলানো জন্য বেশির ভাগ মানুষের প্রস্তুতি থাকে না ফলে অনেকেই দিশেহারা হয়ে যান, চল্লিশোর্ধ প্রায় সবারই বাৎসরিক স্বাস্থ্য চেকআপ প্রয়োজন হয় অনেকেই টাকার শ্রাদ্ধের জন্য এই কাজটাকে বিলাসিতা হিসেবে গণ্য করেন, মোট কথা চিকিৎসা খরচ বাবৎ আমাদের দেশের পরিবারগুলোর সাধারণত কোন বাজেট বরাদ্দ রাখা হয় না।
উপস্থিতির সবাই বিষয়টা স্বীকার করলেন বটে তবে মনে হলো না তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করলেন, একজন বললেন, কথাটা পছন্দ হয়েছে আগে থেকে সেভাবে ভেবে দেখেননি। একজন বললেন, তাদের সমস্যা হলে পরিবারের প্রবাসী সদস্যরা সহযোগিতা করেন।
এই চিত্রটা আমাদের পুরো সমাজেরই একটা রেপ্লিকা।
উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আসলেই একটি ব্যয়বহুল বিষয়। আমাদের দেশে বেসরকারী লেবেলে যে চিকিৎসা খরচ সেটা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। তারপরও এ খরচ মেটাতে জনগনের নাভিশ্বাস উঠে। প্রধান কারণ চিকিৎসার জন্য আলাদাভাবে সঞ্চয় বা পূর্ব প্রস্তুতি না থাকা।
উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশে কোন হেলথ ইনসুরেন্স চালু নাই। ফলে অসুস্থতাকে জীবনের অংশ না ভেবে তারা আপদ বা দুর্ঘটনা হিসেবে ধরে নেন। এ খরচাটা সবার কাছে অনাকাঙ্খিত। এ ব্যয়ভার মেটাতে কেউ কেউ অপরের কাছে হাত পাতেন, সাহায্য চাই বিজ্ঞাপন সাঁটেন, কেউ বা জায়গা জমি অর্ণামেন্টস বিক্রি করেন, নিরুপায় যারা বুকে বোমা বেঁধে শত্রুর ট্যাংকের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো নীলব্যাধিকে আলিঙ্গন করেন।
আমাদের দেশে অনেকেই ফিলানথ্রপি করছেন, নানান আইডিয়া এসেছে, ইউনুস সাহেব নোবেল এনেছেন, আবেদ সাহেব ব্র্যাক করে কর্মসংস্থান করেছেন কিন্তু জনগণের এই করুণ আর্তি মোকাবেলার জন্য কাউকে একটি স্বাস্থ্য ব্যাংক বা হেলথ ইনসুরেন্স বিষয়ে আইডিয়া নিয়ে হাজির হতে দেখা গেলো না।
কত ব্যংকই দেশে অনুমোদন পায়, ব্যাংক কেলেংকারিও কম না, কিন্তু হেলথ ব্যাংটা কখনো হলো না, অথচ দেশের মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে জরুরী।
ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম
ডাঃ মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। ইন্টারনাল মেডিসিন-এ এমডি ডিগ্রীধারী এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সরকারী চাকুরীর পাশাপাশি বর্তমানে পার্কভিউ হসপিটালে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে রোগী দেখছেন।