বোনম্যারো পরীক্ষা কি, কেন ও কিভাবে করা হয়?
বোনম্যারো বা অস্থি মজ্জা হল রক্ত তৈরির কারখানা। এটি থাকে হাড়ের মধ্যে। ইনজেকশন দিয়ে অবশ করার পর একটি ছোট সুঁই দিয়ে কোমরের পাতলা হাড়ের ভিতর থেকে (কখনো কখনো বুকের বা পায়ের হাড় থেকে) অস্থি মজ্জা নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বোন ম্যারোর অবস্থা দেখাকে বোন ম্যারো পরীক্ষা বা বোন ম্যারো স্টাডি/ Bone Marrow Study বলে।
উন্নত বিশ্বে এই পরীক্ষার সাথেই রুটিন হিসেবেই আরেকটি সুঁই দিয়ে পেন্সিলের শীষের মত ছোট আধ ইঞ্চির কম হাড় নেওয়া হয় এবং বিশেষ পদ্ধতিতে মাইক্রোস্কোপে দেখা হয়। একে ট্রেফাইন বায়োপসি /Trephine biopsy বলে। আমাদের দেশেও অনেক সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞগণ বোনম্যারো পরীক্ষার সাথে একই সেটিং এ ট্রেফাইন বায়োপসি পরীক্ষার এই নিয়ম ফলো করছেন।
বোনম্যারো পরীক্ষায় সাধারণত রক্ত তৈরির কোষগুলোর চেহারা দেখা হয়। কোষগুলো স্বাভাবিক চেহারার না অস্বাভাবিক, কোষগুলোর বৃদ্ধির বিভিন্ন ধাপ ঠিক মত আছে কিনা নাকি প্রিমিটিভ বা অপরিপক্ক কোষ যেমন ব্লাস্ট বেশি, কোষের বৃদ্ধি কোন একটা স্টেজে আটকে আছে কিনা, কোন রক্তের বাইরের টিস্যু থেকে টিউমার কোষ যেমন অন্যান্য অংগ থেকে কোন ক্যান্সার কোষ এসে বোন ম্যারোতে জমা হয়েছে কিনা এমনকি শরীরের কিছু ইনফেকশন যেমন কালা জ্বর এর জীবানু কিংবা শরীরে কিছু ভিটামিনের ঘাটতির চিত্রও বোনম্যারো পরীক্ষায় পাওয়া যায়। বোনম্যারো কালচারের মাধ্যমে বিভিন্ন ইনফেকশন নির্ণয় করা যায়।
ট্রেফাইন বায়োপ্সি পরীক্ষা একটা হাড়ের টিস্যুর ভিতরে এভারেজ বোন ম্যারো কোষের সংখ্যা, রক্ততৈরির কোষ বা রক্তের বাইরের ক্যান্সার কোষ ইত্যাদির গড় পরিমান একটি ভিন্ন দৃষ্টি কোণ থেকে দেখতে সাহায্য করে। হাড়ের কোষ ও রক্ততৈরির কোষ গুলো কিভাবে সাজানো আছে, এক জায়গায় বেশি আর এক জায়গায় কম কিনা ইত্যাদি দেখতে ট্রেফাইন বায়োপসির জুড়ি নেই। বোনম্যারোতে যক্ষার বা টিবির জীবানু থাকার কারণে কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা কিংবা বোনম্যারো অধিক শক্ত (fibrosis) হয়ে কাজ করতে পারছেনা কিনা সেটিও বলা যায়। খুব অল্পকিছু ক্ষেত্রে বোনম্যারো পরীক্ষায় একেবারেই স্যাম্পল পাওয়া যায়না। এক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের জন্য ট্রেফাইন বায়োপসি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বলা যায় বোন ম্যারো পরীক্ষা হল একটি ঘরের দুইটি বা একটি রুম আলাদা আলাদা দেখা আর ট্রেফাইনবায়োপসি হল প্রায় অর্ধেক ঘর এর দুই বা তিনটি রুম একটু উপর থেকে একসাথে দেখা। ট্রেফাইন বায়োপসি স্যাম্পল অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। তাই পরবর্তীতে এই স্যাম্পল থেকেই বিভিন্ন পরীক্ষা করা যায়। বিশেষ করে রক্ত ক্যান্সার নির্ণয় ও স্টেজ নির্ণয়ের জন্য বোন ম্যারো আর ট্রেফাইন বায়োপ্সি স্যাম্পল থেকে ফ্লো সাইটোমেট্রি, ইমিউন হিস্টো কেমিস্ট্রি, সাইটোজেনেটিক্স সহ বিভিন্ন মলিকিউলার পরীক্ষা করতে হয়।
বোনম্যারো আর ট্রেফাইন বায়োপসি পরীক্ষা একে অপরের বিকল্প নয় বরং পরিপূরক। প্রায় সময়ই সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষার দুটি অংশই একসাথে করা জরুরি বলে সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। এখন আমাদের দেশেই নিয়মিত এই সব পরীক্ষা হচ্ছে। চট্টগ্রামেও হচ্ছে। বেশি প্রয়োজন হলে চট্টগ্রামেই স্যাম্পল নিয়ে সেটি বিদেশে পাঠানো যায়। বর্তমানে চট্টগ্রামেই উন্নত বিশ্বের মত সম্পূর্ণ ব্যথামুক্তভাবে এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে। চটগ্রামে মহান আল্লহর দয়ায় আমি প্রথম সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত বোনম্যারো ও ট্রেফাইন বায়োপসি পরীক্ষা শুরু করেছি।
বোন ম্যারো পরীক্ষা করার স্যাম্পল নেওয়ার জন্য একজন রোগী যথাযথ ফিট আছেন কিনা, কোন কারণে এখনই বোনম্যারো করলে সঠিক রিপোর্ট আসার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে কিনা, শরীরের কোন অংশ থেকে বোন ম্যারো স্যাম্পল নিতে হবে, রোগী কি লোকাল এনেস্থেসিয়া দিয়ে পরীক্ষা করবেন না আরেকটু বেশি অবস করে পূর্ণাঙ্গ ব্যথামুক্ত বোনম্যারো ও ট্রেফাইন বায়োপসি পরীক্ষা করবেন , দেশের বাইরে মলিকুলার পরীক্ষার স্যাম্পল পাঠাবেন, না দেশেই স্যাম্পল এনালাইসিস করবেন, রোগের প্রয়োজন ও রোগীর অর্থনৈতিক সামর্থ বিবেচনা করে কতটুকু মলিকুলার পরীক্ষা করতে হবে এসব কিছু বিস্তারিত আলোচনার জন্য বোন ম্যারো পরীক্ষা যে সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ স্যার করবেন তাঁর সাথে রোগী ও অভিভাবকের পরীক্ষার আগেই দেখা করা আবশ্যক। না হলে অনেক সময় পরীক্ষার মাঝখানে বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সঠিক রিপোর্ট ও সঠিক ডায়াগনোসিস নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। আর সঠিকভাবে সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ স্যারের সাথে আলোচনা করে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা করলে সঠিকভাবে স্যাম্পল কালেকশন ও রিপোর্ট করা সহজ হয়।
বোনম্যারো পরীক্ষা সংক্রান্ত যে কোন প্রয়োজনেই সম্মানিত রক্তরোগ ও রক্তক্যান্সার বিশেষজ্ঞ স্যারগণের সাথে যোগাযোগ করুন।
আল্লহ আমাদের সবাইকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন।
ডাঃ জামাল তানিন
চট্টগ্রামের প্রথম এমডি ডিগ্রীধারী ব্লাড ক্যান্সার ও রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে রক্ত ক্যান্সার ও রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন।