মাসিকের সমস্যা ও রক্তরোগ
সাধারণত ১০ – ১১ বছর বয়স থেকে মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত এটা চলে (কিছুটা আগে পরে হয়)। সাধারণ হিসেবে মাসে একবার ৩ থেকে ৭ দিন, গড়ে পাঁচ দিনের জন্য ঋতুস্রাব বা মেনসট্রুয়েশন বা মাসিক হয়। এসময় ৩০ থেকে ৮০ এমএল পর্যন্ত রক্ত যেতে পারে (একটু কম বেশি হতে পারে)।
অনেক সময়ই দেখা যায় বিভিন্ন বয়সে মাসিকের বেশ কিছু অনিয়ম হয়। যেমন মাসিক না হওয়া, দেরিতে হওয়া, কম রক্ত যাওয়া, বেশি রক্ত যাওয়া, বেশি সময় ধরে বা কম সময় ধরে মাসিক হওয়া, রক্তপাত বন্ধই না হওয়া, মাসে একাধিকবার বা কয়েকমাসে একবার মাসিক হওয়া, মাসিকের সাথে অনেক বেশি ব্যথা ইত্যাদি। বিভিন্ন কারণে এসব সমস্যা হতে পারে।
মাসিকের বিভিন্ন অনিয়মের সাথে রক্তের কিছু রোগেরও সম্পর্ক আছে।
যাদের মাসিকে অধিক রক্ত যায় কিংবা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দিন ধরে রক্ত যায় বা একমাসেই একাধিকবার মাসিক হয় তাদের অনেক সময়ই রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া দেখা দেয়। কিশোরি মধ্যবয়স্ক বা মেনোপজের কাছাকাছি বয়সের অনেক মহিলাই মাসিকের সমস্যার কারণে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। দিনের পর দিন মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর এই রক্তস্বল্পতা জনীত ক্লান্তি, দূর্বলতা, অবসাদ, মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, খিটখিটে মেজাজ নিয়ে এভাবেই জীবন যাপন করতে থাকেন অনেকেই।
অধিক মাসিক জনীত রক্তপাতের কারণে যেমন রক্তস্বল্পতা হয় তেমনি রক্তের কিছু রোগের কারণে মাসিকে অধিক রক্তপাত হতে পারে। যেমন কোন কারণে রক্তের প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা কমে গেলে মাসিকে অধিক রক্তপাত হতে পারে। আইটিপি (ITP), এপ্লাস্টিক এনিমিয়া, লিউকেমিয়া, SLE (এসএলই), বিভিন্ন ধরনের বাত, লিভারের সমস্যা, ভাইরাস ইনফেকশন ( ডেংগু) সহ বিভিন্ন কারণে রক্তের প্লেটলেট কমে যেতে পারে।
অনেক সময় প্লেটলেট পরিমানে ঠিক থাকলেও প্লেটলেট ঠিকমত কাজ করেনা। বেশ কিছু রোগ এবং ওষুধের কারণে এমন হতে পারে। এ অবস্থায় মাসিকে অধিক রক্তপাত হতে পারে।
রক্তের ভন উইলিব্র্যান্ড ডিসিস (VWD) সহ বিভিন্ন রোগে রক্ত জমাট বাঁধার বিভিন্ন ফ্যাক্টর কমে গেলে বা ঠিকমত কাজ করতে না পারলে মাসিকে অধিক রক্তপাত হতে পারে।
মাসিকে অধিক রক্তপাতের সাথে শরীরে লাল নীল কাল দাগ, মাড়িতে বা প্রস্রাব পায়খানায় রক্ত যাওয়া, জয়েন্ট ফোলা, মুখের ভিতরে ঘা, রোদে গেলে মুখের চামড়া জ্বলা, অনেক বেশি চুল পড়ে যাওয়া, জ্বর, অনেক বেশি শরীর বা জয়েন্ট ব্যথা, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস, গলায় কোমরে বগলে ছোট বলের মত ফোলা বা পেট ফুলে যাওয়া কিংবা একাধিক গর্ভপাত এ ধরণের যে কোন সমস্যা হতে পারে লুকিয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কোন রোগের লক্ষণ।
আর এমনিতেই মাসিকের অধিক রক্তপাতের সাথে দূর্বলতা, বুক ধড়ফর, মাথা ঘোরা, শক্তি না পাওয়া ও ক্লান্তি, কাজ করতে ইচ্ছে না হওয়া, খিটখিটে আর মনমরা ভাব নির্দেশ করে সম্ভবত রক্তস্বল্পতা হয়েই গিয়েছে।
অনেকেই মাসিকে অধিক রক্তপাতকে স্বাভাবিক মনে করেন। এটা নিয়েই খুব কষ্ট করে জীবন কাটান। অথচ খুব সাধারণ কিছু চিকিৎসাই এই অধিক রক্তপাত ও রক্তস্বল্পতার কষ্ট থেকে আমাদের নারী সমাজকে রক্ষা করতে পারে ইনশা আল্লহ । এ জাতীয় যে কোন সমস্যায় নীরবে কষ্ট না পেয়ে একজন সম্মানিত চিকিৎসক এর সাথে যোগাযোগ করুন।
অধিক মাসিক জনীত রক্তস্বল্পতায় রোগীকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব রোগীর অনেকেই শরীরে অপ্রয়োজনীয়ভাবে রক্ত নিচ্ছেন যা বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সম্মানিত চিকিৎসকগণকে অনুরোধ করব এই ধরণের সমস্যার পেছনে কোন রক্তরোগ লুকিয়ে আছে কিনা সেটা খেয়াল রাখা দরকার। প্রয়োজনে সম্মানিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞগণের মতামত নিন।
আমাদের কন্যা, স্ত্রী, বোনেরা, মায়েরা ভাল থাকুক।
মহান আল্লহ আমাদের পরিবারগুলোকে ভাল রাখুন।
ডাঃ জামাল তানিন
চট্টগ্রামের প্রথম এমডি ডিগ্রীধারী ব্লাড ক্যান্সার ও রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বর্তমানেতিনি চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে রক্ত ক্যান্সার ও রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন।