পাইলস কি, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

পাইলস বা ‘হেমোরয়েড’ (বাংলায় অর্শ রোগ, ইংরেজীতে hemorrhoids) নামে পরিচিত আমাদের সমাজে বর্তমানে খুবেই প্রচলিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তিত জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস এর পরিবর্তনসহ নানা কারণে এই রোগ সমাজে বেড়েই চলেছে। আজকের লেখাতে আমরা পাইলস কি, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে জানবো।
পাইলস কি?
পাইলস শরীরের মলদ্বারের একটি অংশ, যা সুস্থ প্রত্যেক মানুষের থাকে। পাইলস মলদ্বারের নিচের দিকের থাকে ,যা রক্তনালী দিয়ে পূর্ণ থাকে। পাইলস মল ও বাতাস ধরে রাখতে সহায়তা করে। যখন এই পাইলস মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে আসে, মলদ্বার দিয়ে রক্ত যায় বা ব্যাথা করে- তখন পাইলস রোগ হয়েছে মনে করা হয়।
পাইলস কয় ধরনের?
পাইলস প্রধানত ২ ধরনের। বহি:স্থ পাইলস ও অভ্যন্তরীণ পাইলস।
বহি:স্থ পাইলস– এটা মলদ্বারের মুখে ও বাইরে থাকে।এটি চামড়ার নিচে থাকে ও সাধারণত ব্যাথা হয়না। মলত্যাগের সময় চাপ দিলে বা বেশিক্ষণ ধরে মলত্যাগ করলে বাইরের পাইলসের মধ্যে রক্ত জমাট বেধে তা শক্ত হয়ে যেতে পারে ও তাতে ব্যাথা করেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটা ফেটে রক্ত বের হতে পারে। অনেকদিন এই পাইলস থাকলে মলদ্বারে চুলকানি ও মলদ্বার পরিস্কার করতে অসুবিধা হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ পাইলস– এটা মলদ্বারের ভিতরে থাকে। এই ধরনের পাইলসের প্রধান উপসর্গ হল মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত ও মলদ্বার বের হয়ে আসা। এই ধরনের পাইলসে ব্যাথা হয়না। যদি ভিতরের পাইলস মলদ্বার দিয়ে বাইরে চলে আসে এবং ভিতরে ঢুকানো সম্ভব না হয় তাহলে ব্যাথা হতে পারে।
পাইলস কেন হয়?
- মলত্যাগে সবসময় চাপ দেয়া
- অনেকক্ষণ ধরে মলত্যাগ করা
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- ডায়রিয়া
- গর্ভাবস্থা
- অনিয়মিত মলত্যাগ
- বার্ধক্য
- উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তি
ধারনা করা হয় যে , সময়ের সাথে সাথে, এই কারণগুলি অভ্যন্তরীণ পাইলসকে নিচের দিকে নামিয়ে দেয় ও বহি:স্থ পাইলসের মধ্যে রক্ত জমাট বাধাতে অবদান রাখতে পারে।
কারণ যাই হোক না কেন, এতে মলদ্বারের শিরার সহন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর ফলে শিরা প্রসারিত হয় ও শিরার প্রাচীর পাতলা হয়ে যায় এবং মলদ্বারে রক্তপাত হয়। পরবর্তীতে মলদ্বার নিচে নেমে আসে।
পাইলস হলে কি সমস্যা হয়?
নিচের যেকোন সমস্যা হলে আপনার পাইলস হবার সম্ভাবনা থাকে,
- মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়া (মলত্যাগের সময় বা মলত্যাগ ছাড়াও)
- মলত্যাগের সময় মলদ্বার নিচের দিকে নেমে যাওয়া (যা নিজে ভিতরে চলে যেতে পারে বা হাত দিয়ে ডুকিয়ে দিতে হয়)
- মলদ্বারে চুলকানি
- ব্যাথা
- মলদ্বারে ফুলা ও ব্যাথা
- অতিরিক্ত ফুলা বা বের হয়ে আসার জন্য মলদ্বার পরিষ্কার রাখতে সমস্যা হওয়া।
পাইলস রোগের চিকিৎসা কি?
- সমস্যা কম হলে শাক-সব্জি, সালাদ তথা আঁশ জাতীয় খাবার ও তরল খাবার বেশি করে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
- একই সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য পরিহার করা, মলত্যাগে অতিরিক্ত চাপ না দেয়া, বেশিক্ষণ ধরে মলত্যাগ না করলে রক্তপাত ও মলদ্বার বের হয়ে আসা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
- মলদ্বারে ব্যাথা থাকলে সিজ বাথ নিলে আরাম লাগে।
- উল্লেখিত নিয়ম মেনে চললে বহি:স্থ পাইলসের ব্যাথা ও ফুলা ২-৭ দিনের মধ্যে কমে যেতে পারে। ফুলা পুরোপুরি সেরে যেতে ৪-৬ সপ্তাহ সময় লাগে। যদি বহি:স্থ পাইলসে তীব্র ব্যাথা থাকলে অপারশন প্রয়োজন হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ পাইলসের উপসর্গ / সমস্যা যদি বেশি হয় তাহলে অপারশন দরকার হয়, যার বেশির ভাগই দিনে দিনে করা সম্ভব।
- ব্যান্ড লাইগেশন– এটি পাইলসের একটি কার্যকারী চিকিৎসা। ব্যান্ড লাইগেশনের মাধ্যমে পাইলসের উপরে একটি ব্যান্ড পড়িয়ে দেয়া হয়, এর ফলে পাইলসের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে পাইলস ও ব্যান্ড ঝরে পরে যায়। ১-২ সপ্তাহের মধ্যে ঘা শুকিয়ে যায়। এই চিকিৎসার পর কিছু ক্ষেত্রে রক্ত যেতে পারে ও মলদ্বারে অস্বস্তি হতে পারে। ব্যান্ড লাইগেশন ২-৩ বার করতে হয়।
- ইনজেকশন এবং ইনফ্রারেড চিকিৎসা– যে পাইলস মলদ্বারের বাইরে বের হয়ে আসেনা সেসব ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা করা যেতে পারে। এই চিকিৎসা সম্পূর্ণ ব্যাথা মুক্ত।
- কেটে পাইলস অপারেশন– এটি পাইলস রোগের সবচেয়ে কার্যকরী অপারেশন। এক্ষেত্রে পাইলস সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হয়। যখন ব্যান্ড লাইগেশন করা /ইঞ্জেকশন দেয়ার পর পাইলস আবার হয় বা যদি অনবরত রক্তপাত হতে থাকে বা পাইলস যদি ভেতরে ডুকানো সম্ভব না হয়, তাহলে কেটে পাইলস অপারেশন করতে হয়। বহি:স্থ পাইলসের ভেতরে বার বার রক্ত জমাট বেধে গেলে পাইলস অপারেশন করে ফেলতে হবে। পাইলস অপারেশনে যে অংশ বের হয়ে আসে ও যা থেকে রক্তপাত হয় তা অপসারণ করা হয়। এটি অবেদন করে করা হয়, কিছু ক্ষেত্রে ১-৩দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।
- লংগো অপারেশন– এটি পাইলস অপারেশনের একটি প্রক্রিয়া। এখানে একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পাইলস কেটে নিয়ে আসা হয়, এর ফলে বহি:স্থ পাইলসে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং তা সংকুচিত হয় যায়। এখানে যন্ত্রের মাধ্যমে কাঁটা ও জোড়া লাগান হয়। একটি যন্ত্র দিয়ে একজন রগির অপারেশন করা যায়, ফলে এই অপারশন ব্যায়বহুল। এই অপারেশনের পর রক্তপাত বা পাইলস বের হয়ে আসেনা। সাধারন কেটে অপাররেশনের তুলনায় অনেক কোন ব্যাথা বা অস্বস্তি হয়। অপাররেশনের পর সিজ বাথ বা ড্রেসিংএর দরকার হয়না। ক্ষতস্থান হতে রক্ত বা রক্তপানি বের হয়না। অপারেশনের ৩-৪ দিনের মধ্যে কাজে যোগদান করতে পারেন।
- টি এইচ ডি অপারেশন– এটি পাইলসের অত্যাধুনিক অপারেশন।এই অপারেশনে পাইলস কাঁটা হয়না, একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাইলসে রক্ত সরবরাহকারি ধমনী বন্ধ করে দেয়া হয় ও মলদ্বারের যে অংশ নিচে নেমে আসে সে অংশকে তার স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই অপারেশনে ব্যাথা কম থাকে, সিজ বাথ বা ড্রেসিং দরকার হয়না।
পাইলস থেকে কি ক্যানসার হতে পারে?
না, পাইলস ও ক্যানসারের মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই। কিন্তু পাইলস রোগে যেসব উপসর্গ থাকে (মলদ্বারে রক্ত যাওয়া) তা ক্যানসার বা খাদ্যনালীর অন্য কোন রোগেও থাকতে পারে। একারনে যেকোনো উপসর্গ থাকলে সে বিষয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার দেখানো উচিৎ। কখনই দোকান থেকে কিনে ঔষধ খাওয়া বা নিজে চিকিতশা করা উচিৎ নয়। বয়স ৫০বছরের বেশি হলে অবশ্যই কলনস্কপি পরীক্ষা করা উচিৎ। মলদ্বারে এধরনের সমস্যা হলে অবশ্যই একজন কলোরেক্টাল সার্জন দেখানো উচিৎ।
কলোরেকটাল সার্জন কি বা কারা
কোলন এবং রেকটাল সার্জন বৃহদান্ত্র, মলদ্বার এবং পায়ূপথের রোগের অপারেশন এবং ঔষধের মাধ্যমে চিকিত্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তারা এই রোগের চিকিত্সার উন্নত অস্ত্রোপচারের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে, পাশাপাশি সাধারণ অপারেশনের প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করেছে। তারা বৃহদান্ত্র, মলদ্বার এবং পায়ূপথের সাধারণ ও ক্যান্সার রোগের চিকিত্সার ক্ষেত্রে সুপরিচিত এবং সুদক্ষ। কোলন এবং রেকটাল সার্জন বৃহদান্ত্র, মলদ্বার ক্যান্সার রোগের স্ক্রীনিং পরীক্ষা করেন এবং বৃহদান্ত্র, মলদ্বার এবং পায়ূপথের যাবতীয় অপারেশন/শল্যচিকিত্সার চিকিত্সা করেন, যদি তা প্রয়োজন হয়।

ডাঃ সৈয়দ মোহাম্মদ শমশের নাহিদ
ডাঃ সৈয়দ মোহাম্মাদ শমশের নাহিদ, ২০০২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এম বি বি এস পাস করেন, ইন্টার্ন সমাপ্ত করে এদেশের স্বনামধন্য কলোরেক্টাল সার্জন প্রফেসর ডাঃ এ কে এম ফজলুল হকের সাথে কাজ শুরু করেন এবং দীর্ঘ সময় সুনাম ও বিশ্বস্ততার সহিত স্যারের সাথে কাজ করেন। ২০০৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। ২০০৬ সাল হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকাল কলেজে জেনারাল সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১০ সালে জানুয়ারি মাসে এফ সি পি এস ডিগ্রী অর্জন করেন। ফেলোশিপ পরীক্ষা পাশের পর হতে ডাঃ সৈয়দ মোহাম্মাদ শমশের নাহিদ শুধুমাত্র কলোরেক্টাল সার্জারি বিষয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। ২০১৩ সালে থাইল্যান্ড, ব্যাংককের এন চি আই (National Cancer Institute, Bangkok, Thailand) ক্যান্সার হাসপাতালে স্তন সার্জারির উপর প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালে আমেরিকান সোসাইটি অফ কলন অ্যান্ড রেকটাল সার্জনস (ASCRS) এর আন্তর্জাতিক বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা গমন করেন এবং আমেরিকার বিখ্যাত মেয়ো ক্লিনিক(Mayo Clinic, Rochester, Minnesota), ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক (Cleveland clinic, Ohio) ক্যান্সার চিকিতসার জন্য বিখ্যাত এম ডি এন্ডারসন(M D Anderson, Houston Texas) হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৫ সালে আমেরিকান সোসাইটি অফ কলন অ্যান্ড রেকটাল সার্জনস ডাঃ সৈয়দ মোহাম্মাদ শমশের নাহিদকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ (FASCRS) প্রদান করে যা, বাংলাদেশে প্রথম। ২০১৭ সালে ডাঃ সৈয়দ মোহাম্মাদ শমশের নাহিদ “টাটা মেমরিয়াল হাসপাতাল”, মুম্বাই ইন্ডিয়াতে বৃহদান্ত্র ও মলদ্বার ক্যান্সার অপারেশনের উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং জার্মানির বার্লিনে(Karl Storz Training certer, Berlin) ফিসটুলা রোগের উপর প্রশিক্ষন নেন। ২০১৭ সালে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কলন প্রকটলজি এর সদস্য হন। এছাড়াও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে এ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং এবিষয়ে তার ৭টি প্রকাশনা রয়েছে।