মায়ের দুধ খাওয়ান, শিশুর জীবন বাচান

মায়ের দুধ সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে শিশুর জন্য রহমত স্বরূপ। অনেক মায়েরা বলেন আমার দুধে পানি বেশি, এই কথার ভিত্তি নেই, কারণ দুধে ৮৮ভাগ পানি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের দুধ ০২ ভাগে বিভক্তঃ
- ১ম ভাগে পানি বেশি থাকে যা শিশুর তৃষ্ণা মেটাবে।
- ২য় ভাগে চর্বি ও ক্যালরী বেশি থাকে যা শিশুর ক্ষিধা মেটাবে।
শাল দুধঃ শিশুর জন্মের প্রথম কয়েকদিন যে ঘন আঠালো হলুদাব দুধ পাওয়া যায় তাহাই শাল দুধ। এটি শিশুর প্রথম টিকা কারণ এতে রোগ প্রতিরোধক অনেক উপাদান থাকে। কিন্তু কুসংষ্কারের কারনে অনেক শিশু শাল দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। মনে রাখবেন জন্মের প্রথম ৬মাস শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ পান করাবেন। মায়ের দুধ ব্যতিত কিছুই খাওয়ানো যাবেনা এমন কি একফোটা পানিওনা। কিন্তু আমাদের সমাজে শিশুকে জন্মের পর মধু, পানি, তেল, চিনির পানি ইত্যাদি খাওয়ানোর প্রচলন দেখা যায় যা নবজাতকের মৃত্যুর জন্য দায়ী কারণঃ
- এটি নবজাতককে শালদুধ থেকে বঞ্চিত করে।
- নবজাতক অসুস্থ হওয়ার ঝুকি বাড়ে।
- নবজাতকের ক্ষিধা নষ্ট করে তাকে মায়ের দুধ খাওয়া থেকে বিরত রাখে।
- আর যদি ফিডার ব্যবহার করা হয় তবে শিশু মায়ের দুধ চুষতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
মায়ের দুধের উপকারিতাঃ
- শিশু জন্মের ১ ঘন্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়ালে নবজাতকের মৃত্যুহার শতকরা ৩১ ভাগ কমানো সম্ভব।
- শিশুর পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শরীরের সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান মায়ের দুধে থাকে।
- মায়ের দুধে রোগ প্রতিরোধক উপাদান থাকে যা শিশুকে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া সহ অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা করে। ভবিষ্যতে শিশুর হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে।
- শিশুকে পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ালে মায়ের শীঘ্রই গর্ভধারণের সম্ভাবনা কম থাকে। পরবর্তীতে মায়ের স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার এবং উচ্চরক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
- শুধুমাত্র মায়ের দুধেই বুদ্ধি বিকাশের একমাত্র উপাদান ডেকোছা হেক্সানোইক এসিড আছে, যার ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ ঠিকমত হয় এবং শিশু বুদ্ধিমান হয়।
গুড়া দুধ বা ফরমুলার অপকারিতাঃ
- গুঁড়া দুধ ও প্রক্রিয়াজাত শিশু খাদ্য সম্পুর্ণ জীবাণুমুক্ত নয় কারণ এতে এন্টারাব্যোকটর সাকাজ্যাকি এবং সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকার সম্ভাবনা বেশী যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- গুড়া দুধ বা প্রক্রিয়াজাত দুধ খাওয়ালে শিশুর ঘন ঘন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া সহ বিভিন্ন রোগে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। ফলে শিশু সহজে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
- গুঁড়া দুধ বা প্রক্রিয়াজাত যে কোন দুধ বা খাদ্য খাওয়ালে শিশুদের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও স্তুল হওয়ার আশংকা বৃদ্ধি পায় এবং প্রসবকালীন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- বোতল, চুষনির বোঁটায় বিসফেনল এ থাকে যা শিশুর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
- গুড়া দুধ বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে মিশ্রিত ডেকোছা হেক্সানোইক এসিড শিশুর বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করে না।
মাতৃ দুগ্ধ পাণকে সফল করার কৌশলঃ
বর্তমানে শতকরা ৩৫ভাগ শিশু মায়ের দুধ পাণ থেকে বঞ্চিত। তাই এই অবস্থার উন্নতি করনে আমারা নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিতে পারিঃ
- মায়ের মনে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে।
- দুধ খাওয়ানোর মায়ের প্রাইভেসি বজায় রাখতে হবে।
- মাতৃদুগ্ধ পাণের উপকারীতা সম্পর্কে মাকে বুঝাতে হবে এবং ফর্মূলা খাওয়ানোর অপকারিতা সম্পর্কে মাকে স্বজাগ করতে হবে।
- মায়ের বাড়তি পূষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
- দুধ পানের সময় শিশুর যথাযথ পজিশন এবং সংযুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
- পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা একান্ত জরুরী।
- বেবী ফ্রেন্ডলী হসপিটাল ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়ন করতে হবে।
- বুকের দুধের বিকল্প আইন ২০১৩ বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিশু যে পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে তা কিভাবে বুঝবেনঃ
- শিশু দৈনিক অন্তত ৮বার দুধ পান করছে।
- শিশুটি ছন্দ বা Rhythmically চুষবে এবং দুধ গিলার সময় একটা শব্দ হবে এবং শিশুটি থেমে থেমে (একটু পজ দিয়ে) দুধ টানছে।
- পরপর দুবার দুধ পানের মাঝের সময়টাতে শিশুকে তৃপ্ত/শান্ত মনে হবে।
- শিশু ‣দনিক ৬ বা তার বেশি বার প্রশ্রাব করবে।
- ৩ থেকে ৮ বার পায়খানা করবে।
- দৈনিক ১৮ থেকে ৩০ গ্রাম ওজন বাড়বে।
- দুধ খাওয়ানোর আগে মায়ের ব্রেষ্ট ফোল মনে হবে এবং খাওয়ানোর পরে খালি মনে হবে।
শিশু দুধ কম পাওয়ার কারণ কিঃ
- শিশুর পজিশন ও সংযুক্তি সঠিক না হওয়াই প্রধান কারন।
- খুব ঘন ঘন, অল্প সময় এবং তাড়াহুড়া করে দুধ খাওয়ানো।
- শিশু ভাল মত দুধ না টানা।
- রাতে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকা।
প্রতিকারঃ
- দুধ খাওয়ানোর সময় পজিশন ও সংযুক্তির উন্নতি ঘটানো।
- প্রতিবার দুই সাইড থেকে খাওয়ানো।
- ঘনঘন ও দীর্ঘ সময় ধরে, দিনে ও রাতে ১০ থেকে ২০ বার দুধ খাওয়ানো।
- ফিডারের ব্যবহার বন্ধ করা।
- মাকে বাড়তি পুষ্টিকর খাবার ও পানি খাওয়ানো।
- মাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও রিলাক্স রাখা।
- দুধ খাওয়ানোর মাঝখানে হাতে চেপে দুধ বের করা এবং তা কাপ/চামচে খাওয়ানো।
বুকের দুধ বের করার কৌশলঃ
শিশু যখন সরাসরি মায়ের বুকের দুধ খেতে পারে না, তখন বুকের দুধ বের করে খাওয়ানো যায় যা নিম্নরূপঃ
প্রথমে নিজের হাত সাবান দিয়ে ধোঁয়ার পর গরম পানিতে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে কয়েক মিনিট স্তন ঢেকে রাখতে হবে, তারপর নিম্নোক্ত যেকোন পদ্ধতিতে দুধ বের করতে হবেঃ
- ১) হাতেঃ হাতের দুই আঙ্গুলে বোটার যে কোন দুই পাশে রেখে আনুমানিক ১.৫ইঞ্চি দূর থেকে বোটার দিকে ম্যাছেজ করে আনতে হবে, এতে ফোঁটায় ফোঁটায় দুধ আসবে যা সাবান দিয়ে ধোয়া বাটিতে নিতে হবে।
- ২) উষ্ণ বোতল পদ্ধতি।
- ৩)ব্রেষ্ট পাম্পের মাধ্যমে।
সংগ্রহ করা দুধ খাওয়ানোর কৌশলঃ
- প্রয়োজনে দুধের বাটিকে গরম পানির কে․টায় রেখে উষ্ণ করতে হবে।
- যতটুকু খাওয়াবে ততটুকুই গরম করবেন। একবার গরম করা দুধ আবার সংরক্ষন করা যাবেনা।
- খাওয়ানোর আগে দুধের কে․টাকে আলতো ভাবে ঝাকানো উত্তম। অতপর কাপ থেকে চামচে করে শিশুকে খাওয়াবেন।
দুধ সংরক্ষনের উপায়ঃ
- স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৮ থেকে ১০ ঘন্টা।
- ফ্রিজের নরমালে ৭২ ঘন্টা।
- দুই দরজার ফ্রিজের শীতল কক্ষে ৩ মাস।
- ডীপ ফ্রিজে ১ বছর।
দুধ মাঃ যে মা নিজের না এরকম একটি বাচ্চাকে যখন দুধ পান করায় তখন তাকে দুধ মা বলা হয়। তবে সেক্ষেত্রে দুধ মাকে সুস্থ হতে হবে।
কর্মজীবী মায়ের করনীয়ঃ
স্তন পানের ক্ষেত্রে ১ম দুই মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা যখন ঘরে থাকে তখন মা থেকে শিশুকে সরাসরি দুধ পান করাবেন, বিশেষ করে রাতে ও সকালে। মা যখন চাকরিতে থাকবেন তার পূর্বে বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য দুধ বের করে যথাযথ নিয়মে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। ঘরে যে সেবা দান কারী থাকবে তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে সে সংগ্রহ করা দুধ সঠিক নিয়মে খাওয়াতে পারে। মা যখন চাকরিতে থাকবেন তখন ২ থেকে ৩ বার দুধ বের করে শিশুর জন্য সংগ্রহ করবেন।
স্তন্য পানের ব্যর্থতার কারণঃ
- মায়ের ইচ্ছার অভাব।
- পরিবার বা স্বাস্থ্য সেবা প্রদান কারীর সহায়তার অভাব।
- ঘনঘন এবং জোরালো ভাবে স্তন্য পান না করানো।
- ফিডার ব্যবহার করা।
- মায়ের স্তনে সমস্যা।
- বুকের দুধ খাওয়ানোর কৌশলগত ত্রুটি। স্তন্যপানের ব্যর্থতার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
- প্রসব পূর্ব চেক আপের জন্য স্তন পরীক্ষা করানো।
- বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মায়ের প্রসবপূর্ব প্রস্তুতি।
- জন্মের ১ ঘন্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়ানো এবং ঘনঘন স্তন্য পান করানো।
- স্তনের সমস্যা থাকলে সেটা সমাধান করা।
- সম্পূর্ন রূপে স্তন্যপান করানো এমনকি হাতে বের করে স্তন খালি করা।
রিল্যাকটেশনঃ
এর মানে হলো এমন একজন মায়ের মধ্যে পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদনের পূনঃ প্রতিষ্ঠা করা যিনি দুধের উৎপাদন অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছেন বা দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এই পদ্ধতিতে মা অনেক বছর স্তন্য পাণ থেকে বিরত আছেন বা এমনকি কখনো মা হননি তিনিও একটি শিশুকে স্তন্য পান করাতে পারবেন।
রিল্যাকটেশনের জন্য করনীয়ঃ
- মাকে উদ্বুদ্ধ করা।
- স্বাস্থ্য সেবা দানকারী এবং মায়ের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উৎসাহ ও সহযোগিতা।
- ঘনঘন স্তন্য পান করানো।
- শিশুকে স্তন্য পান করানোর মধ্যবর্তি সময়ে স্তন্য থেকে হাতে দুধ বের করা।
- স্তন্য পান বাড়িয়ে স্তন্যপানের সম্পূরককে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা।
- সম্পূরকের সহায়তায় শিশুর স্তন্যপানকে উৎসাহিত করা।
স্তন্যপান সম্পুর্ণ্রুপে ব্যর্থ অবস্থা থেকে রিল্যাক্টেশনের উপায়ঃ
- স্তনের বোটায় উদ্দীপনামূলক ব্যায়াম করানো।
- দৈনিক ৮ থেকে ১০ বার এবং প্রতিবার ১০ থেকে ১৫ মিনিট স্তন্য পান করানো।
- স্তন্য পানের সময় ফোঁটায় ফোঁটায় স্তনের উপর থেকে বোটার দিকে দুধ ফেলা যাতে শিশু মনে করে যে স্তন চুষলে মায়ের দুধ পাওয়া যায়।
- স্তন্য পানের সময় দুধের একটি সম্পুরক উৎস স্তনের বোটার সাথে সরূ নালীর মাধ্যমে কসটেপের সহিত লাগিয়ে দেয়া, যাতে শিশু বোটা চুষলে বিকল্প উৎস থেকে দুধ মুখে আসবে এবং এতে শিশু দুধ চুষতে উৎসাহিত হবে।

ডাঃ মনির উল্লাহ
নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মনির উল্লাহ পার্কভিউ হসপিটালে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়মিত রোগী দেখছেন। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তা নবজাতক, শিশু ও কিশোর বয়সের মেডিকেল সমস্যার চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া ছাড়াও শিশুর পুষ্টি, ব্রেস্ট ফিডিং ও সরকারি বেসরকারি টিকাদানের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন।